ম্যালওয়্যার কি, এর প্রকারভেদ ও করণীয়
ম্যালওয়্যার কি
কম্পিউটারে অনুপ্রবেশকারী বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর সফটওয়্যারের নাম হলো ম্যালওয়্যার। ম্যালওয়্যার (Malware) হলো ‘Malicious Software’ এর সংক্ষিপ্ত রূপ ৷ ‘Malicious’ অর্থ দূষিত বা ক্ষতিকর। অর্থাৎ ‘Malicious Software’ হলো দূষিত বা ক্ষতিকর সফটওয়্যার। যা ডিভাইসের ক্ষতিসাধন করে থাকে।
ম্যালওয়্যার এমন এক ধরনের সফটওয়্যার প্রোগ্রাম, যা কম্পিউটার, মোবাইল বা অন্য কোনো ডিভাইসে ব্যবহারকারীর অনুমতি ছাড়াই তার কার্যক্রম সচল রাখতে পারে। যেমন কোন ব্যবহারকারীর অনুমতি ব্যতীত তার গোপন তথ্য চুরি করা, নজরদারি করা, ডিভাইসের কার্যক্ষমতা হ্রাস করা বা ডিভাইসে থাকা গুরুত্বপূর্ণ সব ডাটা সমূহের ক্ষতিসাধন করা। ম্যালওয়্যার শব্দটি 1990 সালে Yisrael Radai ব্যবহারে আনেন।পূর্বে এই জাতীয় সফ্টওয়্যারকে কম্পিউটার ভাইরাস বলা হতো। কিন্তু ম্যালওয়্যার এবং ভাইরাস দুটি একই জিনিস নয়। সমস্ত ভাইরাস হলো ম্যালওয়্যার, তবে ম্যালওয়ারের প্রতিটি অংশই ভাইরাস নয়। আজকে আমরা জানবো বিভিন্ন ধরনের ম্যালওয়্যার, তাদের কাজ এবং প্রতিকার সম্পর্কে।
ম্যালওয়্যারের প্রকারভেদ
ম্যালওয়্যার বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে৷ তবে আমরা বেশিরভাগ যে ম্যালওয়্যারগুলোর সম্মুখীন হয়ে থাকি সেগুলো সম্পর্কে নিচে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলো –
১. ভাইরাস:
ভাইরাস ডিভাইসে পেরালাইজড অবস্থায় থাকে। আপনি যখন ভাইরাসে আক্রান্ত কোনো প্রোগ্রাম ব্যবহার করবেন তখন এটি এক্টিভ হয়ে যাবে এবং নিজে নিজেই কাজ করা শুরু করবে। এটি নিজের প্রতিরূপ তৈরি করে আপনার পুরো ওয়ার্ড প্রসেসিং সফটওয়্যারকেই অকেজো করে ফেলতে পারে।
২. ট্রোজন:
ম্যালওয়্যারের আরেকটি ক্যাটাগরি হলো ট্রোজান। এই ট্রোজান ম্যালওয়্যারের নামকরণ করা হয়েছে ট্রোজান হর্স থেকে এটি সবচেয়ে চালাক প্রকৃতির ম্যালওয়্যার। কারন ট্রোজন অন্যান্য প্রোগ্রামের সাথে ছদ্মবেশে আপনার কম্পিউটারে অতি সহজেই প্রবেশ করতে পারে। এটি আপনার কাছে অত্যন্ত কার্যকরী এবং আকর্ষণীয় রূপে নিজেকে উপস্থাপন করবে যার ফলে আপনার হয়তো মনে হতে পারে এটি একটি আসল সফটওয়্যার কিন্তু এমনটা আসলে নয়। যদি আপনি না বুঝে প্রোগ্রামটি ইন্সটল করে ফেলেন তাহলে এই ট্রোজন ম্যালওয়্যারগুলো আপনার ডিভাইসে থাকা ডাটাসমূহকে ডিলিট, এডিট, মডিফাই করতে সক্ষম। এমনকি আপনার ব্রাউজারে থাকা যাবতীয় পাসওয়ার্ডও চুরি করার ক্ষমতা রাখে।
৩. র্যানসমওয়্যার:
র্যানসমওয়্যার এমন এক ধরনের ম্যালওয়্যার ভাইরাস, যা আপনার কম্পিউটার ডিভাইসকে আক্রমন করে কম্পিউটারের হার্ড ড্রাইভে থাকা সবগুলো ফাইলকে এত বড় কী (Key) দিয়ে লক করে ফেলবে যে, তা প্রযুক্তিগতভাবে আনলক করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। যার ফলে আপনি সেই ফাইলগুলোতে আর প্রবেশ করতে পারবেন না। কারণ সেই ফাইলগুলোতে প্রবেশ করতে হলে আপনাকে অবশ্যই উক্ত হ্যাকারকে মুক্তিপণ দিয়ে কী (Key) নিতে হবে।
৪. ওয়র্মস:
ওয়র্মস সাধারনত নিজেকে গুন করার চেষ্টা করে। এটি আপনার ডিভাইসে যদি প্রবেশ করে তাহলে আপনার ডাটাগুলোকে কপি করে হাজার হাজার ফাইল তৈরি করবে। এবং আপনার সিস্টেমকে স্লো করে দেবে। এছাড়াও আপনার কম্পিউটার থেকে যদি আরেকটি কম্পিউটারে কিছু কপি করেন তবে এটি সেই কম্পিউটারকেও আক্রান্ত করবে।
৫. স্পাইওয়্যার:
স্পাইওয়্যার এর প্রধান কাজ হলো আপনার উপর নজরদারি করা। এটা অনেক সময় ট্রোজান হর্সের চেয়েও ক্ষতিকারক হয়ে যায়, যখন এটা আপনার যাবতীয় গোপন তথ্য, ছবি হ্যাকার বা অন্য ব্যবহারকারীর নিকট পৌঁছে দেয়।
ম্যালওয়্যার যেভাবে ডিভাইসে প্রবেশ করে
ম্যালওয়্যার বিভিন্ন উপায়ে আমাদের ডিভাইসে প্রবেশ করতে পারে। তবে আমাদের অসতর্কতা ম্যালওয়্যার ডিভাইসে ঢোকার অন্যতম কারণ। আসুন, ডিভাইসে ম্যালওয়্যার ঢোকার মাধ্যমগুলো জেনে নিই –
১. সফটওয়্যার ও সিস্টেম আপডেটে অবহেলা করা:
প্রত্যেকটি সফটওয়্যার বা সিস্টেমের কোনো না কোনো ত্রুটি থাকে তার ফলে অতি সহজে হ্যাকাররা যেকোনো ডিভাইসে আক্রমণ করতে পারে। তবে ডেভেলপারগণ সিকিউরিটি আপডেটের মাধ্যমে সেই ত্রুটি সমূহের সমাধান করার চেষ্টা করেন৷ অতএব আপনি যদি প্রতিটি আপডেটের পর আপনার সফটওয়্যার বা সিস্টেমের আপডেট না করেন তাহলে ওই সফটওয়্যার বা সিস্টেমে থাকা ত্রুটি সমূহকে কাজে লাগিয়ে হ্যাকাররা আপনার ডিভাইসে ম্যালওয়্যার ঢুকিয়ে ক্ষতি করে থাকে।
২. অপরিচিত কোনো উৎস হতে পাওয়া মেইল বা ফাইল ওপেন করা:
অনেক সময় দেখা যায় অপরিচিত কোন জায়গা থেকে মেইল আসলে বা কেউ কোন লিংক বা ফাইল দিলে আমরা সেই গুলো চেক না করেই ওপেন করে থাকি। এক্ষেত্রে হতে পারে সেই লিংক বা ফাইল গুলো এমনভাবে তৈরি করা যা ওপেন করার সাথে সাথে ম্যালওয়্যার আপনার ডিভাইসে নিজ থেকে ইন্সটল হয়ে যাবে।
৩. ক্র্যাক সফটওয়্যার ব্যবহার করা:
ম্যালওয়্যার আক্রমণের শিকার হওয়ার অন্যতম একটি কারণ হলো ফ্রিতে ক্র্যাক সফটওয়্যার ব্যবহার করা৷ ইন্টারনেটের বিভিন্ন আনঅফিশিয়াল সোর্স থেকে কোনো সফটওয়্যার ডাউনলোড করার সময় তার সাথে আমাদের ডিভাইসে চলে আসে বিভিন্ন ধরনের ম্যালওয়্যার। যেগুলো আমাদেরকে চরম মাত্রায় ভুগিয়ে থাকে।
ম্যালওয়্যার থেকে বাঁচতে করণীয়
বর্তমান সময়ে অনলাইনে সবচেয়ে বড় হুমকির মধ্যে ম্যালওয়্যার অন্যতম। এটি ২০১৫ সালে ওয়ানাক্রাই আক্রমণ সহ বিশ্বের বৃহত্তম সাইবার-আক্রমণে ব্যবহৃত হয়েছে যা ১৫০ টি দেশে 200,000 এরও বেশি ক্ষতিগ্রস্থকে প্রভাবিত করেছে।ছোট বড় কোম্পানি থেকে শুরু করে এমনকি ব্যক্তিগতভাবে ব্যবহার করা কম্পিউটার, স্মার্টফোনগুলোও ম্যালওয়্যারের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাচ্ছে না। এক্ষেত্রে আমরা সকলে যদি সচেতন হই তাহলে কোনো ম্যালওয়্যার বা হ্যাকার আমাদের ডিভাইসের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।
১.সফটওয়্যার ও সিস্টেম আপডেটে অবহেলা না করে সর্বপ্রথম আপনার ডিভাইসের অপারেটিং সিস্টেম আপডেট রাখুন৷ এক্ষেত্রে অটো-আপডেট অন রাখা অতিব জরুরি।এতে সে নিজের সুরক্ষা নিজেই করে নিতে পারবে৷
২. ম্যালওয়্যার প্রতিরোধে সিকিউরিটি সফটওয়্যার ব্যবহার করা অত্যন্ত জরুরি৷ ‘উইন্ডোজ ডিফেন্ডার’ বর্তমানে শক্তিশালী একটি সিকিউরিটি সফটওয়্যার। তবুও অতিরিক্ত সুরক্ষার জন্য আপনি Eset, Norton, Kaspersky এর মতো সিকিউরিটি সফটওয়্যারগুলোর যেকোনো একটি ব্যবহার করতে পারেন।
৩.ইন্টারনেট থেকে ফ্রিতে ক্র্যাক ফাইল বা সফটওয়্যার ডাউনলোড না করে সবসময় চেষ্টা করতে হবে ট্রাস্টেড কোনো সোর্স হতে ফাইল বা সফটওয়্যার ডাউনলোড করার । এবং ফাইলটি ডাউনলোড করে ওপেন করার আগে অবশ্যই স্ক্যান করে নিতে হবে। যাতে কোনো ম্যালওয়্যার সফটওয়্যারের সাথে আপনার ডিভাইসে ঢুকতে না পড়ে।
৪.সন্দেহজনক কার্যকলাপের জন্য সমস্ত ব্যবহারকারীর অ্যাকাউন্টগুলি পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
৫.ইমেল সুরক্ষা এবং স্প্যাম সুরক্ষা শুনিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে অযাচিত ইমেলগুলি হ্রাস করতে স্প্যাম ফিল্টার সেট করতে হবে।
৬.ওয়েব ব্রাউজ করতে বা ইমেল চেক করতে প্রশাসনিক সুবিধাগুলির ব্যবহার এড়িয়ে চলতে হবে। এক্ষেত্রে শুধুমাত্র প্রশাসনিক কাজ সম্পাদনের জন্য প্রশাসক হিসাবে লগ ইন করতে হবে, যেমন কনফিগারেশন পরিবর্তন করা।
৭.শক্তিশালী ফায়ারওয়্যাল ব্যবহার করতে হবে। এটি ডিভাইসটিকে ম্যালওয়্যার থেকে রক্ষা করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। একটি ফায়ারওয়াল অ্যান্টি-ভাইরাস সফ্টওয়্যার ছাড়াও ম্যালওয়্যারের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত বাধা তৈরি করে, আক্রমণের সম্ভাবনা হ্রাস করে।
বর্তমানে তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে ইন্টারনেট ছাড়া কোন কিছুই কল্পনা করা যায় না। বলতে গেলে ইন্টারনেট হলো পৃথিবীর চালিকা শক্তি সুতরাং ম্যালওয়্যার থেকে বাঁচতে কখনোই আমরা ইন্টারনেট থেকে দুরে থাকতে চাইবো না। এক্ষেত্রে সুরক্ষা শুনিশ্চিত করার পাশাপাশি আমাদের ব্যক্তিগত সচেতনতাই পারে ম্যালওয়্যার প্রতিরোধ গড়ে তুলতে। আমরা যদি সাইবার সিকিউরিটি ও ম্যালওয়্যার সম্পর্কে ভালো ধারনা রাখতে পারি তাহলে হ্যাকারদের ফাঁদে পড়ার সম্ভাবনা অনেকাংশে কমে যাবে৷
লেখাঃ তাফনিন হোসেইন তানি;
কন্টেন্ট রাইটার, YDA